যৌথ ব্যবসার মূলনীতি: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা > শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী

আমাদের সমাজে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে এবং যে বীভৎস রূপ ধারণ করেছে, তা আদালতে দায়েরকৃত মামলা-মোকদ্দমার পরিসংখ্যান দ্বারা কিছুটা অনুমান করা যায়। তবে; বাস্তবিকপক্ষে ঝগড়া-বিবাদের সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। আদালতের ব্যয় নির্বাহ অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে, অনেক বিবাদ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে না। কিন্তু বিবাদের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। একে অপরকে কষ্ট দেওয়া ও হেয় প্রতিপন্ন করার সবাত্মক চেষ্টাও চলতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ শত্রুতার আগুন বংশপরিক্রমার কয়েক ধাপ পর্যন্ত গড়াতে থাকে।

এ সমস্ত ঝগড়া-বিবাদের কারণ খতিয়ে দেখলে অর্থকড়ি ও জায়গাজমিই বেশির ভাগ কারণ হিসেবে দেখা যাবে। টাকা-পয়সা এবং জমির বিবাদ রক্তের সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বের ঘনিষ্ট বন্ধনকেও মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দেয়। বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব চোখের পলকে শত্রুতায় পরিণত হয়।

এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে, একটি প্রধান কারণ হল, পারস্পরিক মালিকানা অস্বচ্ছ থাকা, লেনদেন পরিষ্কার না রাখা। ইসলামের এক সোনালি শিক্ষা হল, ‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস কর। আর অপরিচিতের ন্যায় লেনদেন কর।’ অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে পরস্পরের সঙ্গে এমন আচরণ কর, যেমনটি এক ভাইয়ের অপর ভাইয়ের সাথে করা উচিত। ভদ্রতা, উদারতা, সহনশীলতা ও হৃদ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাও। আচার-আচরণে ত্যাগ স্বীকার করে অপরকে প্রাধান্য দাও। কিন্তু পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকলেও টাকা-পয়সার লেনদেন, জায়গা-জমির আদান প্রদান ও অংশীদারিত্বের কারবার এমনভাবে সম্পাদন কর, যেমন, দুজন অপরিচিত ব্যক্তি সম্পাদন করে থাকে। অর্থাৎ লেনদেন ও কায়-কারবারের প্রতিটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া উচিত। কারবারের কোনো দিকই যেন অস্পষ্ট না থাকে, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত।

পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং সুমধুর সম্পর্ক থাকাকালে যদি ইসলামের এ মূল্যবান শিক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে পরবর্তীতে উদ্ভূত অনেক ফেতনা-ফাসাদের পথ এখানেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে এ মূল্যবান শিক্ষার প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। উপরন্তু কেউ এ স্বচ্ছতার প্রস্তাব দিলে, তা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পরিপন্থী বলে মনে করা হয়। প্রস্তাবকারীকে হেয়-প্রতিপন্ন করা হয়, যার ফল পরবর্তীতে সকলকে ভোগ করতে হয়।

নিম্নে এ অস্বচ্ছতার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হল-

অনেক সময় দেখা যায়, ভাই-বেরাদার ও পিতা-পুত্র মিলে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে। আর সাধারণত হিসাব-নিকাশ ছাড়াই প্রত্যেকে নিজ প্রয়োজন অনুপাতে তা হতে ব্যয় করতে থাকে। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে কার কী অবস্থান, তা স্পষ্ট করা হয় না। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে, না বেতনভিত্তিতে, নাকি সহযোগী হিসেবে। বেতন ভিত্তিতে হলে, বেতন কত, আর অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হলে, তা কী পরিমাণ-এ সকল বিষয় অস্পষ্ট থাকে, কিছুই চূড়ান্ত করা হয় না। প্রত্যেকেই নিজ চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবসার অর্থ ব্যয় করতে থাকে। যদি কেউ বেতন বা অংশীদারিত্বের পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলে, তাহলে তা ঐক্য ও সম্প্রীতি পরিপন্থী মনে করা হয়। অথচ সমাজে প্রতিনিয়তই পরিলক্ষিত হচ্ছে, যে, এ ধরনের অস্বচ্ছ যৌথ ব্যবসার ফলে পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদ জন্ম নিচ্ছে। অন্তরে অন্তরে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ধুমায়িত হচ্ছে। বিশেষত অংশীদারদের যখন বিয়ে-শাদি হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই মনে করে, যে, অপর অংশীদাররা ব্যবসা দ্বারা বেশি সুবিধা লাভ করছে। আমার সাথে অবিচার করা হচ্ছে। তখন বাহ্যত পারস্পরিক সম্প্রীতি দৃষ্টিগোচর হলেও ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ ও ক্ষোভের লাভা উত্তপ্ত হতে থাকে। অবশেষে এ ক্ষোভ  ও অবিশ্বাস পর্বতাকার ধারণ করে। আর তা আগ্নেয়গিরির রূপ নেয়। তখন ঐক্য আর সম্প্রীতির সব শ্লোগান মুখ থুবড়ে পড়ে। মৌখিক বচসা থেকে শুরু করে ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা কোনোটাই বাকি থাকে না। ভাইয়ে ভাইয়ে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে একে অপরের চেহারা দেখতেও তখন রাজি থাকে না। যার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসার যে পরিমাণ থাকে, সে নির্দ্বিধায় ঐ পরিমাণের ভোগ দখল করতে থাকে। আদল ও ইনসাফ তখন নীরবে নিভৃতে কাঁদে। অধিকন্তু প্রত্যেকেই নিজ নিজ আসরে অপরের কুৎসা রটনায় মগ্ন থাকে।

আর যেহেতু দীর্ঘকাল যাবত চলতে থাকা এ যৌথ কারবারের কোনো মূলনীতি নির্ধারিত ছিল না। সুষ্ঠু হিসাব নিকাশও ছিল না, তাই দ্বন্দ সৃষ্টি হলে পারস্পরিক সমঝোতার বিষয়টিও অত্যন্ত জটিল হয়ে যায়। ন্যায়সঙ্গত সমাধান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থের দৃষ্টিতে ঘটনা বিশ্লেষণ করতে থাকে। ফলে সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য সমঝোতার কোনো উপায় বের করা সম্ভব হয় না।

বলাবাহুল্য, এ সকল ফেতনা ফাসাদের কারণ কেবল এটিই, যে ব্যবসার সূচনায় ও পরবর্তীতে অপর কেউ অংশগ্রহণের সময় কোনো মূলনীতি চূড়ান্ত করা হয়নি। যদি শুরুতেই কার কী অবস্থান হবে, কার কী দায়িত্ব কর্তব্য হবে, কার প্রাপ্য কী হবে, এ বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হত এবং তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হত, তাহলে পরবর্তীতে সৃষ্ট অনেক ফেতনা ফাসাদের দ্বার শুরুতেই বন্ধ হয়ে যেত।

কুরআন মজীদের সর্বাধিক দীর্ঘ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতিকে হেদায়েত দান করেছেন যে, “যখন তোমরা বাকিতে  লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে।” সাধারণ বাকি লেনদেনকেই যখন লিখে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তখন যৌথ কারবারের মতো জটিল বিষয়টিতে কার প্রাপ্য কী হবে, তা লিখে রাখার গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।

এই নির্দেশ এজন্যই দেওয়া হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে ঝগড়া-বিবাদ ও মতবিরোধ সৃষ্টি না হয়। আর হলেও তা ন্যয়নীতির সাথে সমাধান করা যায়।

অতএব, কোনো ব্যবসায় যদি একাধিক ব্যক্তি কাজ করে, তাহলে প্রথম ধাপেই এ বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া জরুরি, যে, এ ব্যবসায় কার কী অবস্থান হবে। এমনকি যদি বাবার ব্যবসায় ছেলে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলেও প্রথমদিনেই এ বিষয়টি শরীয়তের দৃষ্টিতে চূড়ান্ত হওয়া জরুরি, যে, সে কি বেতনের ভিত্তিতে কাজ করবে, না ব্যবসার যথারীতি অংশীদার হিসেবে, কিংবা কেবল বাবার সাহায্যকারী হিসেবে। বেতনের ভিত্তিতে হলে বেতনের পরিমাণ নির্ধারিত হওয়া উচিত। আর যদি পিতা তাকে ব্যবসার মালিকানায় অংশীদার বানাতে চায়, তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে এর প্রথম শর্ত হল, ছেলের পক্ষ থেকে ব্যবসায় মূলধন যুক্ত করা (এ মূলধন সংযুক্তির একটি পন্থা এও হতে পারে যে, পিতা ছেলেকে কিছু নগদ অর্থ প্রদান করবে। ছেলে ঐ অর্থ দ্বারা ব্যবসার নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ ক্রয় করে নিবে।) দ্বিতীয় বিষয়টি লিখিত আকারে যৌথ ব্যবসার ডকুমেন্ট স্বরূপ সংরক্ষণ করা উচিত। ডকুমেন্টে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা জরুরি যে, লভ্যাংশের কে কত শতাংশ পাবে। যাতে পরবর্তীতে কোনো প্রকার জটিলতা সৃষ্টি না হয়।

যদি কোনো অংশীদারের ব্যবসায় অধিক সময় দিতে হয়, অধিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাহলে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া উচিত, যে, অধিক কাজ কি বিনিময়হীন স্বেচ্ছা সেবা হিসেবে করবে, না এর বিনিময়ে সে পারিশ্রমিক বা লভ্যাংশের হার বৃদ্ধি করে নিবে। মোঁকথা, দায়দায়িত্ব ও প্রাপ্য সকল বিষয়ই স্পষ্ট হওয়া জরুরি। আর যদি সহযোগী হিসেবে পিতার ব্যবসায় বিনিময়হীন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকে, তাহলে ব্যবসা হতে সে কিছুই পাবে না।

যদি কারো যৌথ ব্যবসায় উপরোক্ত বিষয়গুলো এখনো চূড়ান্ত না করা হয়, তাহলে অতি দ্রুত তা চূড়ান্ত করা বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে লজ্জা, তিরষ্কার, তাচ্ছিল্য কিংবা উদারতা কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক হওয়া উচিত নয়। যৌথ কারবারের এ স্বচ্ছতাকে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পরিপন্থী মনে করা মস্ত বড় শয়তানী ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়; বরং ঐক্য ও সম্প্রীতি স্থায়িত্ব এ স্বচ্ছতার উপরই নির্ভরশীল। অন্যথায় এ বাহ্য ভালবাসাই শত্রুতার জন্ম দিবে। আর এজন্য ইসলামের সোনালী শিক্ষা হল,‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস কর আর অপরিচিতের ন্যায় লেনদেন কর।’

২. আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্যও এককভাবে গৃহ নির্মাণ বড় কঠিন বিষয়। তাই সাধারণত গৃহ ক্রয় বা নির্মাণ পরিবারের একাধিক সদস্য মিলে যৌথভাবেই হয়ে থাকে। বাবা বাড়ি নির্মাণ করলে, ছেলেরাও সামর্থ্য অনুপাতে নিজেদের অর্থ দিয়ে থাকে। সাধারণত তা কোনো বিষয় চূড়ান্ত করা ছাড়াই হয়ে থাকে। (কী পরিমাণ দেওয়া হচ্ছে, তার হিসাবও রাখা হয় না।) তা কি ছেলের পক্ষ থেকে বাবার জন্য হাদিয়া-সহযোগিতা, না ঋণ, নাকি বাড়ির মালিকানায় অংশগ্রহণ কিছুই স্বচ্ছ থাকে না। অথচ হাদিয়া বা দান হলে বাড়ির মালিকানায় সে অংশীদার হবে না এবং এ টাকা সে কখনো ফেরত পাবে না। ঋণ হলে বাড়ির একক মালিকানা পিতার হবে, আর ছেলের প্রদত্ত অর্থ পিতার দায়িত্বে ঋণস্বরূপ থাকবে। আর যদি বাড়ির মালিকানায় অংশীদার হওয়ার জন্য টাকা দেওয়া হয়, তাহলে অর্থের পরিমাণ অনুযায়ী বাড়ির মালিকানা লাভ করবে। বাড়ির মূল্য বৃদ্ধি ঘটলে, তার প্রাপ্য মালিকানারও মূল্য বৃদ্ধি পাবে। মোঁকথা, প্রত্যেক অবস্থার ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন।  কিন্তু যেহেতু অর্থ দেওয়ার সময় কোনো বিষয় চূড়ান্ত করা হয়নি, প্রদত্ত টাকার হিসাবও রাখা হয়নি, তাই পরবর্তীতে কোনো বিরোধ দেখা দিলে; বিশেষ করে এ অবস্থায় বাবার মৃত্যু হলে, উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে অবর্ণনীয় জটিলতার সৃষ্টি হয়। যারা গৃহ নির্মাণে অর্থ ব্যয় করেছে, তাদের সাথে অন্যদের সীমাহীন দ্বন্দ সৃষ্টি হয়। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কখনো এ বিবাদে পুরো বংশ জড়িয়ে যায়।

যদি ইসলামের সোনালী শিক্ষা অনুসরণ করে গৃহ নির্মাণের পূর্বেই এ বিষয়টি চূড়ান্ত করা হত, আর তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হত, তাহলে পারিবারিক এ দ্বন্দ-কলহের সুযোগ সৃষ্টি হত না।

 

৩. পরিবারের কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে শরীয়তের নির্দেশ হল, অনতিবিলম্বে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজে শরীয়তের এ নির্দেশ পালনে চরম অবহেলা-উদাসীনতা বিরাজমান। কোথাও তো হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে যে যা পায়, তার উপরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আবার কোথাও এমন মন্দ নিয়ত না থাকলেও অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে সম্পত্তি বণ্টন করা হয় না। যদি মৃত ব্যক্তির কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে, তাহলে জীবদ্দশায় যে সন্তান তার দেখাশুনা বা সহযোগিতা করত, সেই তা দেখাশোনা করতে থাকে। কিন্তু এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় না, যে, এখন ব্যবসার মালিকানা কার, আর তা কী পরিমাণ। উত্তরাধিকারীদের অংশ কী হারে পরিশোধ করা হবে। ব্যবসায় যে ভাই শ্রম দিচ্ছে, সে এর বিনিময়ে কী পাবে; বরং কেউ যদি সম্পত্তি বণ্টনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাহলে তার এ প্রস্তাবকে সমাজে ঘৃণিত ও দোষনীয় মনে করা হয়। বলা হয় মৃত ব্যক্তির কাফনও এখনো পুরাতন হয়নি, জীবিতরা সম্পদ ভাগ বাটোয়ারার ধান্ধায় পড়ে গেছে।

অথচ এ বণ্টন শরীয়তের নির্দেশ, স্বচ্ছ মালিকানার দাবিও বটে। কিন্তু এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আর এ অবহেলার ফলাফলই কিছুদিন পর প্রকাশ পেতে থাকে। সময় অতিবাহিত হলে পরস্পরের নিজ প্রাপ্য ও অধিকারের কথা স্মরণ হয়। অসন্তোষ ও ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। সময়ের ব্যবধানে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধিতে বড় ধরনের তারতম্য ঘটে গেলে পারস্পরিক দ্বন্দ-কলহও বড় আকার ধারণ করে। সে দ্বন্দ-কলহের উপযুক্ত কোনো সমাধানও খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন এ বিবাদ হাটে ঘাটে প্রসার লাভ করে। এমনকি কখনো আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

যদি শরীয়তের নির্দেশ অনুযায়ী যথাসময়ে সম্পদ বণ্টন হয়ে যেত, তাহলে সকলের সন্তুষ্টিতে সব বিষয় মীমাংসা হয়ে যেত। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেত।

উপরোক্ত আলোচনায় সমাজে প্রচলিত কেবল তিনটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হল। অন্যথায় সমাজে বিস্তৃত ঝগড়া-বিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হলে দেখা যাবে, মালিকানার অস্বচ্ছতা ও লেনদেনের অপরিচ্ছন্নতা মহামারির আকার ধারণ করে আছে, যার ফলে সৃষ্ট হচ্ছে অসংখ্য অগণিত ফেতনা-ফাসাদ, দ্বন্দ-কলহ। লেনদেন ছোঁ হোক বা বড় তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। তার শর্তসমূহ স্বচ্ছ ও অস্পষ্টতামুক্ত হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কোনো সংকোচ, লজ্জা, উদারতা বা লৌকিকতা কোনো কিছুই প্রতিবন্ধক না হওয়া উচিত। এভাবে লেনদেনের শর্তসমূহ পরিষ্কার করে পারস্পরিক যত সদাচার করা যায় ততই ভালো। নিজে ত্যাগ স্বীকার করে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করাই কাম্য। বলাবাহুল্য, এটিই উদ্দেশ্য হল শরীয়তের এ নীতির-‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস কর আর অপরিচিতের ন্যায় লেনদেন কর।’

 

অনুবাদ: ইসহাক কামাল

 

 

 

 

 

 

 

আখেরী মুনাজাতে আমরা হাত উঠাইলাম, আল্লাহ তিন দিন সাড়ে তিন দিন পর্যন্ত যত নেকী হয়েছে, দোয়া-দরূদ, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার আমরা যা করেছি, এর মধ্যে যাহা ভুল হইয়াছে তা আপনি মেহেরবানী করে মাফ করে দেন। আল্লাহ! এতে যা সাওয়াব হয়েছে তামাম আম্বিয়ায়ে কেরাম খাছ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা পাকে পৌঁছাইয়া দেন। তামাম আজওয়াজে মোতাহহারাত, তামাম আওলাদে আসহাব, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আইম্মায়ে মোজতাহেদীন, ওলামায়ে মোতাকাদ্দেমীন, মোতাআখ্খেরীন, মাশায়েখে তরীকত, আউলিয়ায়ে কেরাম সবার রূহ পাকের ওপর উহার সাওয়াব পৌঁছাইয়া দিন। আল্লাহ্, সমস্ত মোমেন, মোমেনাত; খাছ করে আমাদের বাপ-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়-স্বজন যার যে কবরে শুইয়া আছে সবার কবরে এর সাওয়াব পৌঁছাইয়া দিন। মাবুদগো! তোমার মুর্দা, যিন্দা সমস্ত প্রিয় বান্দা-বান্দীর বরকতে আমাদেরকেও মাফ করে দাও। ও আল্লাহ! মাবুদগো! তুমি যদি আমাদেরকে মাফ না করে জাহান্নামে দাও, তোমার তো কোন লাভ হবে না। যদি মেহেরবানী করে মাফ করে দাও, তোমার তো কোন ক্ষতিও হবে না। আল্লাহ! আপনি মেহেরবানী করে মাফ করে দিন। আল্লাহ! আমাদের আর কিছুই নাই, মাফ পাওয়ার মত কিছুই নাই, তবে একটা বড় আশা-ভরসা, আমরা তোমার হাবিবের এতিম উম্মত, তোমার হাবিবের তোফায়েলে তুমি আমাদেরকে মাফ করে দাও। আল্লাহ যত দিন যেন্দা রাখেন ইসলামের ওপর যেন্দা রাখেন। আল্লাহ যখন মউত দিবেন তখন ঈমানের সাথে মউত দিয়েন। ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! যারা দোয়া চাইছে দুনিয়াতে নাই, দোয়া চাইছে দুনিয়াতে আছে, আপনি জানেন কে কোন নিয়তে দোয়া চাইছে? আল্লাহ আপনি সবার দোয়া কবুল করে নেন। ইয়া আল্লাহ-

আল্লাহ আপনি নেককারদের সাথে আমাদেরকেও কবুল করে নেন। আমাদের সবাইকে কবুল করে নেন। মাওলা! ভিক্ষুক এক দুয়ারে যদি কিছু না পায় আর এক দুয়ারে যাইয়া কিছু না কিছু পায়। আমরা তোমার দুয়ারে হাত বাড়াইছি। তুমি যদি খালি হাতে ফিরাইয়া দাও, আর তো দুয়ার নাইরে মাওলা, আর তো মাওলা নাই। আল্লাহ তুমি যে কাজে যে কথায় যে খেয়ালে রাজি খুশি ঐ কাজ ঐ নিয়ত ঐ আমল করার তাওফিক আমাদেরকে দান কর। আল্লাহ! হক আমাদের কাছে হক বলে প্রকাশ করে দাও। আল্লাহ! হকের ওপর চলার তাওফিক দিয়া দাও। আল্লাহ! না হক আমাদের কাছে না হক বলে প্রকাশ করে দাও। না হক থেকে বাঁচিয়া থাকার তাওফিক দান কর। সারা দুনিয়ার মুসলমান বড় অশান্তিতে আছে, আল্লাহ! সারা দুনিয়ার মুসলমান খাছ করে বাংলাদেশের মুসলমানকে শান্তিতে রাখেন। সমস্ত মানুষকে আপনি শান্তিতে রাখেন। ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদের হেদায়াত নসিব করেন। আমাদের আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র সবাইকে হেদায়াত নসিব করেন। সারা দেশবাসীকে আপনি হেদায়াত নসিব করেন। সারা দুনিয়াবাসীকে আপনি হোদায়াত নসিব করেন। ইয়া আল্লাহ! সমস্ত বালা মুসিবত থেকে আপনি হেফাজতে রাখেন। জালেমের জুলুম থেকে হেফাজতে রাখেন, শত্রুর শত্রুতা থেকে হেফাজতে রাখেন, হিংসুকের হিংসা থেকে হেফাজতে রাখেন, যাদুকরের যাদু থেকে হেফাজতে রাখেন।

ইয়া আল্লাহ! সমস্ত আসমানী যমীনী বালা থেকে হেফাজতে রাখেন। আল্লাহ, এই মাহফিল এত সুন্দরভাবে হওয়ার তাওফিক দিলেন এর শোকরিয়া করার শক্তি আমাদের নাই। আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ! তোমার তারিফ করার ক্ষমতা আমাদের নাই, শুধু আলহামদুলিল্লাহ। নবীর তারিফ করার কোন ক্ষমতা আমাদের নাই শুধু দরুদ পাঠ করলাম আল্লাহ। আল্লাহ, যারা মেয়ে নিয়া বিপদে আছে বিবাহ হয় নাই, তাদের বিবাহ হওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন, যাদের ছেলে নিয়া বিপদে আছে বিবাহ হয় না, তাদের ছেলেদের বিবাহের বন্দোবস্ত করে দেন। আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! যে সকল মেয়ে লোক স্বামী নিয়া বিপদে আছে, তাদের স্বামীদেরকে হেদায়াত করে দেন। আল্লাহ! যে সমস্ত পুরুষেরা বিবি নিয়া মুসিবতে আছেন, আল্লাহ তাদের বিবিদেরকে হেদায়াত করে দেন। যারা ব্যারাম পীড়ায় ভোগতেছে তাদের ব্যারাম পীড়া থেকে শেফা দিয়া দেন। আল্লাহ ব্যারাম পীড়া থেকে শেফা দিয়া দেন, আল্লাহ ব্যারাম পীড়া থেকে শেফা দেন।

আল্লাহ! যারা যেইভাবে দীনের খেদমত করতেছে, সবাইকে সহিহভাবে দীনের খেদমত করার তাওফিক দান করেন। আল্লাহ! সবাইকে দীনের খেদমত করার তাওফিক দান করেন। আল্লাহ! সমস্ত মাদরাসাগুলো- যেখান থেকে দীনের সহিহ খেদমত হয় সে সমস্ত মাদরাসাগুলো কবুল করে নেন। আল্লাহ যারা পীরক্ষা দিবে দোয়া চাইছে, আপনি তাদের পরীক্ষায় কামিয়াব করেন। আল্লাহ! যারা যেভাবে দোয়া চাইছে বা চাইতে পারে নাই, আপনি জানেন, তাদের দেলের নেক মাকসুদগুলো পুরা করে দেন। হে আল্লাহ, রাস্তা-ঘাটে,  ক্ষেতে-খামারে, লঞ্চে, স্টিমারে, গাড়িতে সব জায়গায় আল্লাহ আপনি আমাদেরকে হেফাজত করেন। আল্লাহ! যে যেই রোগে ভোগতেছি প্রত্যেকের রোগ থেকে শেফা দান করুন। আল্লাহ! যেই কথা যেই কাজে যেই চিন্তায় আপনি রাজি খুশি থাকেন ঐ কথা বলার তাওফিক দিন, ঐ কাজ করার তাওফিক দিন, ঐ চিন্তা করার তাওফিক দিন। যেই কথা যেই কাজে যেই চিন্তায় আপনি বেজার ঐ কথা বলা থেকে আমাদের বিরত রাখেন, ঐ কাজ করা থেকে আমাদের বিরত রাখেন, ঐ চিন্তা থেকে আপনি আমাদের বিরত রাখেন।

আল্লাহ! আপনি আমাদের যেহেন শক্তি বাড়াইয়া দিন। কুরআন-হাদিস সহিহভাবে বোঝার এবং তার ওপর সহিহভাবে আমল করার তাওফিক দান করেন। আল্লাহ! তামাম যেন্দা মুর্দা সমস্ত আওলিয়ায়ে কেরামের রূহানী ফয়েজ আমাদের নসিব করেন। আল্লাহ, দীন দুনিয়াতে আপনি আমাদের বরকত দান করেন। ও আল্লাহ! আমাদের দীন দুনিয়া, জাহের, বাতেন, আওলাদ-ফরযন্দ, মাল-দৌলত, মাদরাসা, তরিকা, মাহফিল, ইসলামী হুকুমত, কুরআন শিক্ষা বোর্ড সব আপনার হাতে সোপর্দ করলাম। আপনি মেহেরবানী করে কবুল করে নেন। আল্লাহ আপনার হাতে সব সোপর্দ করলাম।

আল্লাহ! কত কথা আছে বলতে পারলাম না। মাবুদগো! তবে আপনার হাবিব যা ভাল জিনিস আপনার কাছে চাইছেন আমরাও সেই সমস্ত ভাল জিনিস আপনার কাছে চাইলাম। আপনি মেহেরবানী করে আমাদেরকে দান করেন। আল্লাহ! আপনার হাবিব যে সমস্ত খারাপ জিনিস থেকে পানাহ চাইছেন, ঐ সমস্ত খারাপ জিনিস থেকে আমরাও আপনার কাছে পানাহ চাই, আপনি আমাদেরকে খারাপ জিনিস থেকে পানাহ দেন। ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে মাফ করেন, আমাদের বাপ-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-বন্ধু, স্ত্রী-পুত্র, পরিজন, ওস্তাদ-শাগরেদ যে যার কবরে শুইয়া আছে সকলকে আপনি মাফ করে দেন। সুবহানা রাব্বিকা রাব্বিল ইজ্জাতি আম্মা ইয়াসিফুন। ওয়া সালামুন আলাল মুরসালিন। ওয়ালহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।

শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

একনজরে বামুক

  • প্রতিষ্ঠাতা : মাওলানা সৈয়দ এসহাক রহ.
  • বর্তমান আমীর : মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম
  • সেক্রেটারি জেনারেল : খন্দকার গোলাম মাওলা
  • প্রতিষ্ঠার তারিখ : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২
  • কার্যকরী সদর দপ্তর : ৩৭/১ (৬ষ্ঠ তলা, ফারজানা টাওয়ার), নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০

মুজাহিদ আবেদন ফরম

চরমোনাই তরিকার মুজাহিদ হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত ফরমের মাধ্যমে আবেদন করুন

বই অর্ডার ফরম

মুজাহিদ নিবন্ধন ফরম

চরমোনাই তরিকার মুজাহিদগণের আবেদনের প্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত ফরমের মাধ্যমে নিবন্ধন করুন

হালকায়ে যিকির কমিটির রেজিস্ট্রেশন ফরম

চরমোনাই তরিকার হালকায়ে যিকির কমিটি নিম্নোক্ত ফরমের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করুন